প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
রাসেল অন্যান্য শিশুর মতোই হাসতো, খেলতো এবং গল্প করতো। বাবা দেশের কাজের জন্যে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন। মিটিং-মিছিল, কখনো আবার মাসের-পর-মাস জেলখানায় পড়ে থাকতেন। তাই বাবাকে খুব বেশি কাছে পেতো না রাসেল। অর্থাৎ শিশু রাসেলের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বাবাকে ছাড়াই। এমনকি যেদিন রাসেলের জন্ম হয় (১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর), বঙ্গবন্ধু সেদিন ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারণায় অংশগ্রহণের জন্যে চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক বন্দি হয়ে কারাগারে ছিলেন দীর্ঘদিন। বাবাকে দেখতে না পেয়ে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে ‘আব্বা’ বলে সম্বোধন করতেন রাসেল। এই চাপা কষ্ট যেমন অনুভব করতেন ছোট্ট শিশু রাসেল, ঠিক তেমনি তার বাবা শেখ মুজিবও। যা স্পষ্টত ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর লেখা আত্মজীবনীতেও।
বাবা জেলে থাকায় বাড়িটা থাকতো সবসময় নীরব-নিস্তব্ধ। রাসেলেরও থাকতো মন খারাপ। বাবা কোথায় আছে, কেমন আছে, কবে আসবে ইত্যাদি প্রায়ই মায়ের কাছে জানতে চাইতো। অবুঝ এই শিশুকে কি জবাব দেবে মা? শুধু বলতেন, আমিই তোর বাবা। মহীয়সী মা রাসেলের মনকে আরো চাঙ্গা রাখার জন্যে কিনে দিয়েছিলেন একটি তিন চাক্কার সাইকেল। রাসেল সারাদিন বাড়ির আঙ্গিনায় সাইকেল নিয়ে এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াতো।
বাবার মতো রাসেল বাড়ির কুকুর এবং কবুতরকেও খুব ভালোবাসতো। খিদে পেলে মায়ের কাছ থেকে খাবার নিয়ে কবুতর ও কুকুরকে খাওয়াতো। কুকুরটির নাম ছিলো টমি। একদিন খেলার সময় টমি রাসেলের সাথে ঘেউ ঘেউ করলে রাসেল খুব ভয় পেয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে ছোট আপার কাছে নালিশ দেয় যে টমি তাকে বকা দিয়েছে। যে টমিকে এতো আদর করে খাওয়ায় সে টমি কখনো তাকে এভাবে বকা দিতে পারে না- এটাই ছিলো অবুঝমনা শিশু রাসেলের হিসাব। এমন একটা অবুঝ নিষ্পাপ, চঞ্চল ও দুরন্ত ছোট্ট শিশুকেও নরপিচাশ ঘাতকরা হত্যা করতে দ্বিধা করেনি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে একদল বিপথগামী তরুণ সেনা কর্মকর্তা ট্যাঙ্ক দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু, তার পরিবার এবং তার ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সাথে শেখ রাসেলকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে রাসেলকে নিয়ে পালানোর সময় ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ রাসেলকে অভ্যুত্থানকারীরা আটক করে। আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, আমি মায়ের কাছে যাবো। পরবর্তীতে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করে বলেছিলেন, আমাকে মেরো না, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি হাসু আপার কাছে চলে যাবো। আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দাও। নিষ্পাপ রাসেলের সেই কান্নাজড়িত আকুতি-মিনতি মনে হয় আজো সকলের কানে বেজে ওঠে। জানি না সেদিন ওই ছোট্ট শিশু রাসেল বাঁচার জন্যে আর কীভাবে অনুনয়-বিনয় করেছিলেন নরপিচাশ ঘাতকদেরকে (মহান আল্লাহ রাসেল, বঙ্গবন্ধুসহ ওইদিন শহীদদেরকে বেহেস্ত নসিব করুন)। মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচা সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে রাসেলকে। ওই ছোট্ট বুকটা তখন ব্যথায় কষ্টে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো নিশ্চয়ই। যাদের সান্নিধ্যে ¯েœহ-আদরে হেসে খেলে বড় হয়েছে তাদের নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে ওর মনের কি অবস্থা হয়েছিলো- কি কষ্ট ও যন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিলো সেদিন রাসেলের।
রাসেল নামটি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল পৃথিবী বিখ্যাত বৃটিশ দার্শনিক ও সাহিত্যে নোবেল পুস্কারপ্রাপ্ত। আসলে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভীষণ পড়ুয়া। জেলে বসেই প্রচুর পড়াশোনা করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝে শেখ রাসেলের মাকে (শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) ব্যাখ্যা করে শোনাতেন বার্ট্রান্ড রাসেলের দর্শন ও দার্শনিকতা। এসব শুনে রাসেলের ভক্ত হয়ে ওঠেন মা এবং নিজের ছোট সন্তানের নাম রাখেন রাসেল। এ নামটিকে ঘিরে নিশ্চয়ই তার মহৎ কোনো স্বপ্ন বা আকাক্সক্ষা ছিলো। বেঁচে থাকলে রাসেল হয়তো বা সামিল হতেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ বিনির্মাণে। বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয় এখন যেমন দেশের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন, বেঁচে থাকলে তিনিও নিঃসন্দেহে নিজেকে দেশের জন্যে নিয়োজিত রাখতেন। কিংবা হতে পারতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বিশ্ববরেণ্য নেতা। হয়তো হতেন পারতেন বিজ্ঞানী অথবা জাতির পিতার মতো বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার কাণ্ডারী। কিংবা হতে পারতেন বার্ট্রান্ড রাসেলের মতোই স্বমহিমায় উজ্জ্বল বিশ্বমানবতার প্রতীক।
শেখ রাসেলের স্মৃতিকে জাগরুক রাখার জন্যে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র। এটি বাংলাদেশের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল ক্লাব। ১৯৯৫ সালে পাইওনিয়ার ফুটবল লিগে খেলার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে ক্লাবটি। ১৯৮৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা ‘শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ‘ নামে এ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে করেন। সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের মাধ্যমে শেখ রাসেল স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। রাসেলকে নিয়ে একটি বইও লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বইটির নাম ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’। এদিকে আইসিটি বিভাগের তত্ত্বাবধানে দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১০,০০০ সংখ্যক ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব’ নামে কম্পিউটার ল্যাবরেটরী তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যেই অর্ধেকেরও বেশি ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। ডিজিটাল ল্যাবের উদ্দেশ্য হলো তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা দেয়া, প্রশিক্ষণ পরিচালনা ও ল্যাবগুলোকে আইটি হাব হিসেবে গড়ে তোলা। আবার মরণের পরেও যাতে ভুলে না যায়, সেজন্যে মৃত্যুর পর কবরের পাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার ছোট ছেলে শেখ রাসেলের ছবি রাখার কথা বলে গেছেন সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুস শহিদ মিয়া। মাত্র ২০ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মোঃ আব্দুস শহিদ মিয়া। এছাড়া দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নানাবিধ সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান।
‘আমি মায়ের কাছে যাবো’ এটিই ছিলো মৃত্যুর পূর্বে শেখ রাসেলের শেষ কথা। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে বর্বর খুনিচক্রের নির্মম বুলেটে নিহত হয় ১০ বছরের শিশু রাসেল। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি-বিজড়িত ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে শেখ রাসেল জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুর সময় রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হত ৫৭। ঘাতকরা তাকে বাঁচতে দেয়নি। তার আকুতি ঘাতকদের মনকে বিন্দুমাত্র ধাক্কা দিতে পারেনি। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে রাসেল ছিলো সর্বকনিষ্ঠ। ভাই-বোনদের মধ্যে অন্যান্যরা হলেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল এবং বোন শেখ রেহানা।
শিশু রাসেলকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ঘাতকরা মানবসভ্যতার ইতিহাসে জঘন্যতম অপরাধ করেছে। এ ধরনের নিষ্ঠুর ও বর্বর হত্যাকাণ্ড শুধু রাসেলের জীবনকেই কেড়ে নেয়নি। সেই সঙ্গে ধ্বংস করেছে তার সব অবিকশিত সম্ভাবনাও। শেখ রাসেল তার সোনালি শৈশব পেরুতে পারেনি, পারেনি বলতে তার মনের ইচ্ছার কথা বাবাকে, মাকে কিংবা হাসু আপাকে। ঘাতকের বুলেট স্তব্ধ করে দিয়েছে তার দুরন্ত পথচলা, মুখফোটা হাসি। রাসেল বুঝতো না রাজনীতির কিছুই, কিন্তু তাকেই কি না হতে হলো রাজনীতির নিষ্পাপ বলি। বাবা রাজনীতি করতেন কিন্তু তাতে রাসেলের কি দোষ ছিলো? কে দেবে এই প্রশ্নের জবাব? নির্মমভাবে ঘাতকরা নিষ্পাপ শিশুটির দেহটিকে শেষ করতে পেরেছে ঠিকই, শেষ করতে পারেনি রাসেলকে এদেশের লক্ষ-কোটি শিশুর মন থেকে। রাসেল আজও বেঁচে আছে অগণিত শিশুর মনের অন্তরে, বাতাসে ভাসছে তার অকৃত্রিম হাসি, ঝলঝলে উজ্জ্বল চোখ, মাথাভরা ঘন কালো চুল, হৈ-হল্লা করছে ল্যাবরেটরি স্কুলে বন্ধুদের সাথে, মাকে ডাকছে বাবা বাবা বলে। রাসেল বেঁচে থাকবে চিরদিন বন্ধু হয়ে কিংবা ইতিহাস হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, বঙ্গবন্ধুর এ সোনার বাংলায় হাজার বছর ধরে।
তথ্যসূত্র
১। শেখ রাসেল : একটি স্বপ্নের মৃত্যু : প্রফেসর ড. মোঃ সাজ্জাদ হোসেন। সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। বাংলাদেশ সময় : অক্টোবর ১৮, ২০১৯।
৩। ছোট্ট-শেখ-রাসেলের-গল্প : শৈলেন শাহরিয়ার (https:/ww/w.ntvbd.com/kids/17686/ছোট্ট-শেখ-রাসেলের-গল্প)।
২। আমি মায়ের কাছে যাবো-শেখ রাসেল : নওশের আলী হিরা।
৪। শেখ রাসেল : উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে।
লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।