প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুঁজিবাদের ধারক-বাহক এবং বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশ হিসেবে অভিহিত। বিশ্বে এমন কোনো রাষ্ট্র নেই, যে রাষ্ট্র আমেরিকাকে সমীহ করে না এবং আমেরিকার কূটনৈতিক-ষড়যন্ত্র, ক্ষমতা ও অস্ত্রবাজিকে ভয় পায় না। সমগ্র পৃথিবীতেই আমেরিকা একটি আতঙ্কের নাম বললে অত্যুক্তি হবে না। আমেরিকার নিপুণ ষড়যন্ত্রের কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে এবং লেখা হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ধন-সম্পদ লোভের বশে সারা বিশ্বে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেওয়ার অভিনব কৌশল এঁটে আসছে।
গণতন্ত্র ও মানবতা লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে দোহাই দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্লোগানে পুরো বিশ্বের অনেক দেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছে। কর্নেল গাদ্দাফি, সাদ্দাম হোসেনকে শুধু নিহতই করেনি তাদের পুরো পরিবার তছনছ এবং রাষ্ট্রকে প্রায় অকার্যকর করে দিয়েছে। আমেরিকার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদ। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা যে আগুন লাগিয়েছিল, সে আগুনের তাপ শেষ হতে না হতেই ইউরোপজুড়ে আবার জ্বলে উঠছে যুদ্ধের দাবানল। আমেরিকার চরিত্র বলতে কিছু নেই, তার কাজ হলো লুণ্ঠন। এই লুণ্ঠনের সুবিধার্থে সে দেশে দেশে প্রয়োজনে সামরিক শাসন আনে। একসময় নিকট অতীতে পৃথিবীর প্রায় ৭০টির মতো দেশে আমেরিকার ষড়যন্ত্রে সামরিক শাসন ছিল। এখনও যেসব রাষ্ট্রে সামরিক শাসন আছে, সেখানেও আছে আমেরিকার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ হাত। টাকা আর সম্পদের লোভে তার সাথে ডলারের আধিপত্য টিকে রাখার কল্পে পৃথিবীকে অস্থির করার জন্য আমেরিকা যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছে, তাতে মনে হচ্ছে সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন সমগ্র বিশ্ব একসঙ্গে বলে উঠবে--শোষিত-বঞ্চিত, নিপীড়িত লড়াকু মানুষ জেগে উঠো, আমেরিকার আগ্রাসন ও তাণ্ডব প্রতিহত করো এবং পৃথিবী বাঁচাও।
ন্যাটোর কাঁধে চড়ে আমেরিকা অনেক দেশকে সর্বস্বান্ত করেছে। এশিয়ার দেশগুলো যেভাবে একের পর এক ধ্বংস করেছে প্রায়, তার সহিংসতা ও নির্মমতা চেঙ্গিস খান কিংবা হালাকু খানকেও হার মানিয়েছে। তারা চায় পৃথিবীর সব দেশ তাদের কথায় উঠবস করুক। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ঘটনা পুরো পৃথিবীতে আমেরিকার মুখোশ খুলে দিয়েছে। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রতিদিনই দর্পচূর্ণ হচ্ছে আমেরিকার। যুদ্ধের মাঠে ইউক্রেনকে দেখা গেলেও ইউক্রেনের পশ্চাতে যুদ্ধ করছে ন্যাটো তথা আমেরিকা। ইউক্রেন যুদ্ধ এখন পর্যন্ত টিকে আছে আমেরিকার কূটচাল ও অপশক্তি প্রদর্শনের জন্যে। রাশিয়া একের পর এক ইউক্রেনীয় অঞ্চল দখলে নিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে, ছায়া-যুদ্ধ খেলে আমেরিকা সুবিধা করা তো দূরের কথা, বাস্তব যুদ্ধেও রাশিয়া আমেরিকাকে ছেড়ে কথা বলার নয়। রাশিয়ার সাথে সুর মিলিয়েছে ইরান, চীনসহ বিশ্বের আরও অনেক দেশ। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের ধারণা, এখনও সময় আছে, এই যুদ্ধে আমেরিকা সংযত না হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন আমেরিকার বিরুদ্ধে। এমনকি প্রয়োজনে রাশিয়া পারমাণবিক বোমা ফাটাতেও দ্বিধা করবে না। পুতিনের আগ্রাসী মনোভাব আমেরিকা বুঝতে পেরে দেশে দেশে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে এবং যাকে যেভাবে পারছে ম্যানেজ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, আমেরিকার সঙ্গে যারা অন্ধকারে হাত মিলিয়েছে তারা শেষ হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। আর যারা বুক ফুলিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে তারাই বিজয়ী হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভিয়েতনাম, কিউবা অথবা বলিভিয়ার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এমনকি বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত দিলেও বোধহয় কোনো প্রকার ভুল হবে না।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরা দেখেছি কীভাবে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাকে আমেরিকা সমর্থন করেছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিঘিœত করার জন্যে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে, এমনকি চরম অন্যায়ভাবে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর চেষ্টা করেছে, যা প্রতিহত করার হুমকি দিয়ে রোধ করেছিল রাশিয়া। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার মাথায় তাদের সারাক্ষণ দুষ্টবুদ্ধি আছর করে। এরা একদিকে গণহারে মুসলমান হত্যা করে, আবার অন্যদিকে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে জিইয়ে রাখার কৌশল অবলম্বন করে। তালেবান, আল-কায়দা, আইএস প্রভৃতি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে তাদেরই সৃষ্টি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা বিগত দিনে ম্যারি অ্যান পিটার্স নামে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে দেখেছিলাম, মসজিদের ইমামদের প্রশিক্ষণে হাফ স্কার্ট পরে হাজির হন ইমামদের ছবক দিতে। তিনি জামায়াত নেতাদের সঙ্গেও স্পেশাল স্কার্ট জামা পরে দেখা করেন এবং জামায়াতিদের মডারেট ডেমোক্র্যাটিক মুসলিম বলে অভিহিত করেন। ইমাম সাহেবরা ও জামায়াত নেতারা সেদিন বেশ পুলক বোধ করেছিলেন মেরি অ্যান পিটার্সের কথায়। হ্যারি কে টমাস এসে তো পুরো দেশেই জঙ্গি তৎপরতা ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন।
আমেরিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি। তাই তারা বাংলাদেশের জন্ম থেকেই বাংলাদেশকে নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। বাংলাদেশে যতগুলো জাতীয়-রাজনৈতিক দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছে তার সবগুলোর পেছনেই ছিল আমেরিকার গোপন ষড়যন্ত্র। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডি, জেলের মধ্যে জাতীয় চার নেতা ও ১৯৭৬ সালে কর্নেল তাহের হত্যা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ১/১১- এর সেনা সমর্থিত ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দীন-মঈন ইউ আহমেদের তথাকথিত পুতুল সরকারসহ সবখানেই রয়েছে আমেরিকার অলৌকিক চক্রান্তের ছাপ, কিন্তু এতো কিছু করেও আমেরিকা বাংলাদেশের তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। নিকট ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হয় না। সব বাধা অতিক্রম করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত শিখরে।
বিগত দিনে আমেরিকা বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক খেলা খেলেছে, এখনও খেলছে। বাংলাদেশবিরোধী শিবিরে গিয়ে সে এখন নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলছে। বাংলাদেশে দুয়েকটি অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ড ঘটলে আমেরিকা অভিযোগ তোলে। অথচ আমেরিকাতে এমন কোনো দিন নেই, যেদিন এরকম হত্যাকাণ্ড না ঘটে। ওদের স্কুলগুলোতে কোমলমতি শিশুদের গুলি করে হত্যা করা হয়, কৃষ্ণাঙ্গদের মারা হয়, কিন্তু এরপরেও বাংলাদেশর আইন-শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা নিয়ে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত কথা বললে সেটা বাংলাদেশের জন্য মর্মপীড়ার কারণ হয়ে উঠে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বললে বলতে হয়, বাংলাদেশ আমেরিকার চেয়ে সভ্য। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আমেরিকা যেতে চাইলে ভোগান্তি ও ভিসা ফি গুণে গুণে শেষ। অথচ বঙ্গবন্ধুর ঘাতকসহ দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত অনেক ক্রিমিনাল ঠিকই বহাল তবিয়তে আছে আমেরিকায়। বাংলাদেশের ভালো মানুষেরা আমেরিকার ভিসা পায় না, কিন্তু খুনিরা, ক্রিমিনালরা ঠিকই আমেরিকার ভিসা পায়। এগুলো ভালো আচরণ হতে পারে না।
পৃথিবী প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তিত হচ্ছে। সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়, একদিন কেউ আর আটলান্টিক মহাসাগর পার হতে চাইবে না। বিগত দুটো বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার গায়ে কোনো আঁচড় লাগেনি। আমেরিকা আজ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানোর পাঁয়তারা করছে। সেই যুদ্ধে আমেরিকা নিজেরাই প্রথম ধ্বংস হবে। কারণ সমগ্র পৃথিবীকে খেপিয়ে পৃথিবীর সব দেশকে শত্রুদেশে পরিণত করে আমেরিকা একা ভালো থাকতে পারবে না। আজ আমেরিকার ভাবার সময় এসেছে, বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করতে হবে। তা না হলে হয়তো নিকট ভবিষ্যতের যে কোনো সময় আমেরিকার নিজের কর্মফল ভোগ করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার পাশে কেউ থাকবে না। আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করে বিশ্বে নতুন শক্তির উদয় হচ্ছে।
লেখক পরিচিতি :
অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা ; সমাজ ও রাজনীতিবিশ্লেষক।