প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর ক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যু
ফরিদগঞ্জে এক বছরে পানিতে ডুবে ২২ শিশুর মৃত্যু
এক জরিপে জানা যায়, জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় বাংলাদেশে। এমনকি রোগে ভুগে মৃত্যুর চেয়ে দেশটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হারই বেশি বলে মনে করেন গবেষকরা। ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য মতে, ২০২২ সালে পানিতে পড়ার পর হাসপাতালে এনেছে এমন শিশুর সংখ্যা ৩১ জন।
|আরো খবর
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পানিতে ডুবে বেশি শিশুর মৃত্যু ঘটে এশিয়াতেই, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায়। বাংলাদেশে পানিতে ডুবে দিনে গড়ে ৪০টি শিশু মারা যাচ্ছে। ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস, জন হপকিন্স ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরি রিসার্চ ইউনিট, দি সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বা সি.আই.পি.আর.বি. এবং আই.সি.ডি.ডি.আর.বি’র এক গবেষণায় এই তথ্য বের হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান বলেছেন, প্রতিবেশী ভারতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় বেশি হলেও জনসংখ্যার অনুপাতে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু হার বাংলাদেশেই বেশি। তিনি আরো বলেন, সবাই বলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি মারা যায়; কিন্তু আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। কিন্তু এটা রিপোর্ট হয় না। পুলিশের খাতায়ও এদের সংখ্যা থাকে না।
হেলথ ও ইনজুরি সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, ইনজুরি বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুর ক্ষেত্রে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যু। যা মোট মৃত্যুর ১১.৭ শতাংশ। তবে এটি সব বয়সী মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপের তথ্য। সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারায় মানুষ আত্মহত্যা (১৪.৭ শতাংশ) করে। প্রতি বছর এ ধরনের বারোটি ইনজুরি থেকে মৃত্যুর সংখ্যা দেশে এক লাখেরও বেশি। অর্থাৎ যত মানুষ দেশে মারা যায় তার ১২ শতাংশই ইনজুরি জনিত কারণে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য মতে, ২০২২ সালে হাসপাতালে পানিতে পড়া শিশু এসেছে ৩১ জন। এদের মধ্যে ২০ জনই মারা গেছে। উপজেলায় গত বছর যে সব শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ৭ এপ্রিল ১৫নং রূপসা উত্তর ইউনিয়নের গাব্দেরগাঁও গ্রামে সুমাইয়া নামের ৮ বছর বয়সের শিশু সকাল ১১টার দিকে খেলতে খেলতে পুকুরে পড়ে মারা যায়। ১ আগস্ট ৯নং গোবিন্দপুর উত্তর ইউনিয়নে মোঃ সালমান নামের দেড় বছরের এক শিশু খেলতে খেলতে পুকুরের পানিতে পড়ে যায়। পুকুরের পানিতে ডুবে তার মৃত্যু হয়। ১২ নভেম্বর গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নের আনিছ হোসেন (২) ও একই ইউনিয়নের হোগলী গ্রামের নূর মোহাম্মদ (২) সকালের দিকে খেলতে খেলতে পুকুরের পানিতে ডুবে মারা যায়। ২৭ ডিসেম্বর ১৪নং ফরিদগঞ্জ দক্ষিণ ইউনিয়নের চরবড়ালী গ্রামের মামুন ভূঁইয়ার দেড় বছরের মেয়ে মারিয়া পানিতে ডুবে মারা যায়।
সংবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যুর অধিকাংশ সময় সকাল ১০ টা থেকে ১টার মধ্যে। এবং যেসব শিশু মারা গেছে তাদের বসতির পাশেই পুকুর অথবা ডোবা রয়েছে। মূলত দেখণ্ডভাল করার অভাবেই এই মৃত্যুগুলো হয়েছে। যে সময়টায় শিশু পানিতে পড়ছে ঐ সময়টায় মায়েরা ব্যস্ত থাকেন রান্না বা বাড়ির কাজে, বাবারা কাজে ঘরের বাহিরে এবং বড় ভাই-বোন (যদি থাকে) তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকে।
বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শিশুদের নিয়ে কাজ করা ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরামের বর্তমান কমিটির সভাপতি কবি পাভেল আল ইমরান এ বিষয়ে বলেন, সবার আগে প্রয়োজন বাচ্চাদের প্রতি আমাদের মনোযোগী হওয়া। সেই সাথে থাকতে হবে প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞান, যাতে তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, হাসপাতালে নিতে নিতে বাচ্চা মারা যায়। অথচ আমরা যদি পানি থেকে উঠিয়েই হার্ট ও শ্বাস-প্রশ্বাস চালুর প্রাথমিক চেষ্টা করি, তাহলে বাচ্চা বেঁচেও যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, অনেক ক্ষেত্রে ডুবে যাওয়া শিশুকে কী করা হবে বা ফার্স্ট রেসপন্স সম্পর্কে প্রশিক্ষিত ব্যক্তির অভাব রয়েছে। পানিতে পড়ে ডুবে মারা যাওয়া দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার ব্যাপারে সরকারি এবং এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। কিছু সুনির্দিষ্ট কাজ করতে হবে। যেমন-কমিউনিটি সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সেই সাথে শিশুকে পানি থেকে উদ্ধার করে তার শ্বাস ও হার্ট চালু করার যেসব প্রাথমিক কাজ আছে সেগুলো মানুষকে শেখাতে হবে। হাসপাতালে আনতে আনতে অনেকেই বাঁচে না। তাই যারা উদ্ধার করেন তাদের যদি প্রাথমিক ওই জ্ঞান থাকে তাহলে অনেক শিশুই বেঁচে যাবে। যে সংসারে মা বাবা দু’জনই চাকরিজীবী তাদের শিশুদের জন্য ‘ডে কেয়ারে’র ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা সরকারিভাবে মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেও হতে পারে, আবার বেসরকারি উদ্যোগেও হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ত্বরান্বিত করার ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডাঃ মোজ্জামেল পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর জন্য কয়েকটি রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে বলেন, সবচেয়ে বিপজ্জনক পুকুর (৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা পুকুরেই হয়ে, যেটি একেবারেই বাড়ির পাশে থাকে)। এছাড়া খাল, বিল, ডোবাতো আছেই। বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সাঁতার না জানা, তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞান না থাকা। তারপরে আধুনিক যুগে এসেও আমাদের সমাজে কিছু কুসংস্কার রয়ে গেছে। পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ৫ বছরের নিচের শিশুদের সঠিক তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। ৫ বছরের বেশি বয়সীদের সাঁতার শেখাতে হবে।